বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

❒ যশোরের যশ, খেজুরের রস

একশ কোটি টাকার রসালো স্বপ্নেও গাছির হাহাকার

মনিরুজ্জামান মনির মনিরুজ্জামান মনির
প্রকাশ : শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর,২০২৫, ০৬:০৮ পিএম
আপডেট : শনিবার, ৬ ডিসেম্বর,২০২৫, ০৭:৪৪ এ এম
একশ কোটি টাকার রসালো স্বপ্নেও গাছির হাহাকার

❒ যশোরের মাঠে মাঠে চাষিরা বাস্ত খেজুর রস উৎপাদনে ছবি: ধ্রুব নিউজ

‘রস তৈরিতে অনেক পরিশ্রম। টাকা হলেও এ কাজে জান থাকে না। গুড় জ্বাল দেওয়ার জন্য এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানির দুষ্প্রাপ্যতা ‘

শীত পড়েছে। সকালের কুয়াশা সরিয়ে যশোরের গ্রামীণ জনপদে এখন এক সুমিষ্ট গন্ধের আনাগোনা। এই গন্ধ খেজুরের রসের, যা থেকে তৈরি হয় বিশ্বখ্যাত নলেন পাটালি। ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’ — কেবল প্রবাদ নয়, এটি এখানকার অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক অফিস প্রায় একশ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখছে। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনার আড়ালে চাপা পড়ে আছে কারিগর বা গাছিদের নীরব সংগ্রাম।

শীত আসার প্রায় পাঁচ সপ্তাহ আগেই গাছিরা খেজুর গাছ পরিষ্কার (ঝোড়া) করেন এবং রসের মুখ তৈরির জন্য বিশেষ দা দিয়ে গাছের ডগা চেঁছে (চাঁছ দেয়া) প্রস্তুত করেন। এটি এক অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও নিপুণ কাজ। এরপর গাছের ছেঁচে নেওয়া অংশটিতে বিশেষ ধরনের বাঁশের 'নলি' বসানো হয়, যা বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রস সংগ্রহ পাত্রে (ভাড়) জমা হয়। সাধারণত প্রথমবার রস সংগ্রহের পর গাছটিকে বিশ্রাম দেওয়া হয়। আর সবচেয়ে মিষ্টি ও ঘন রস পাওয়া যায় শীতের তীব্রতা বাড়লে— অর্থাৎ পৌষ-মাঘ মাসে। এই সময়ের রস থেকেই তৈরি হয় কিংবদন্তী নলেন গুড়।  রাতের শীতল রস ভোরে সংগ্রহ করে দ্রুত জ্বাল দেওয়া হয়। মাটির উনুনে বিশাল কড়াইয়ে সারাদিন জ্বাল দিয়ে গাঢ় করা হয় সেই রস। এই ঘন রস যখন বিশেষ তাপমাত্রায় আসে, তখনই তৈরি হয় সেই সুস্বাদু দানা গুড়, নলেন পাটালি এবং ঝোলা গুড়। গুড় জমাট বাঁধার এই প্রক্রিয়াটি এক ধরনের কারিগরী শিল্প, যা বংশপরম্পরায় হস্তান্তরিত হয়েছে।

যশোরের গাছিরা এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছরই নামেন এক কঠিন যুদ্ধে। ভোরের কুয়াশায় গাছ কেটে রস সংগ্রহ থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুড় তৈরির অবিরাম পরিশ্রম।

আগ্রাইল গ্রামের গাছি আলী হোসেন এই সংগ্রামের ছবিটা তুলে ধরলেন, ‘গাছে রস আসা শুরু করেছে। রস তৈরিতে অনেক পরিশ্রম। টাকা হলেও এ কাজে জান (জীবন) থাকে না।’ তিনি আরও যোগ করেন, গুড় জ্বাল দেওয়ার জন্য এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানির দুষ্প্রাপ্যতা।

লাউখালী গ্রামের গাছি আব্দুস সালাম জানান, ‘আমি হাপানিয়া গ্রামের মাঠে খেজুর গাছ কাটি। মোট মাঠ কুড়িয়ে ১’শ গাছ কাটি। রস আসা শুরু করেছে তবে এখনও পরিমানে কম। তবে দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে মানুষ আসল আর নকল বোঝে না। যার কারণে বাজারজাত করতে বড় সমস্যায় পড়ি।’

হাঁপানিয়া গ্রামের হাসান আলী জানান, ‘রাস্তার দু’পাশ দিয়ে কিছু গাছ আছে। তাছাড়া জমির আইলের উপর এখন আর গাছ নেই। মাঠের সেই ৫০-৬০ বছর বয়েসের গাছ আর নেই। এ কারণে রসও অনেক কম।’

শর্শনাদাহ গ্রামের গাছি রেজাউল করিম জানান, ‘খেজুর গাছে রস বের করা অনেক কঠিন কাজ। বর্তমানে বয়েস হওয়ার কারণে শরীরে আর তাগুত নেই। যার কারণে এ বছর গাছ কাটা কম করে দিছি। যা কাটছি তাতে রস আশা শুরু করেছে।’

যশোরের কারিগরদের বানানো নলেন পাটালির কদর দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও। তেঁজরোল গ্রামের মিলন হোসেন জানান, ‘শীতের এই ৪-৫ মাস আমাদের খেজুর গাছের উপর সংসার চলে। এ বছর শুরুতে মোটা পাটালি ৮’শ থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি করছি।’ 

জিআই (Geographical Indication) তকমা প্রাপ্ত এই পণ্যটির বাজার যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন এর মূল ভিত্তিটিই দুর্বল হয়ে পড়ছে।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, জেলায় মোট খেজুর গাছের সংখ্যা ১৬ লাখ ২৫ হাজার, কিন্তু মাত্র ৩ লাখ ২১ হাজার গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। আর এই বিশাল সংখ্যক গাছ থেকে রস বের করার জন্য দক্ষ গাছি আছেন মাত্র ৫ হাজার ৫০ জন।

হাঁপানিয়া গ্রামের হাসান আলী বলেন, ‘রাস্তার দু’পাশ দিয়ে কিছু গাছ আছে। তাছাড়া জমির আইলের উপর এখন আর গাছ নেই। মাঠের সেই ৫০-৬০ বছর বয়সের গাছ আর নেই। এ কারণে রসও অনেক কম।’ অর্থাৎ, একদিকে গাছের সংখ্যা কমছে, অন্যদিকে কমছে দক্ষ কারিগর।

গাছিদের আক্ষেপের আরেকটি বড় কারণ বাজারে নকল গুড়ের বাড়বাড়ন্ত। লাউখালী গ্রামের গাছি আব্দুস সালাম এর অভিযোগ, ‘বর্তমানে মানুষ আসল আর নকল বোঝে না। যার কারণে বাজারজাত করতে বড় সমস্যায় পড়ি।’ ভেজাল গুড় কম দামে বিক্রি হওয়ায় আসল গুড়ের কারিগররা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে, নিপা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও উদ্বেগের কারণ। যদিও তেঁজরোলের মিলন হোসেন জানান, ‘আসলে আমরা এ বিষয়ে ভালো বুঝি না। কারণ আমাদের পরিবারের সবাই তো কাঁচা রস খায়। আল্লাহর রহমতে আমাদের এখনও কোনো সমস্যা হয়নি।’ তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিপা ভাইরাস মুক্ত রস ও গুড় উৎপাদনে সচেতনতামূলক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমাদের বড় সমস্য হচ্ছে দিন দিন গাছির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যার ফলে গাছির সংকট দেখা দিচ্ছে।’

তিনি আশ্বস্ত করেন, ‘আমাদের নতুন গাছি তৈরীর লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি পরিপত্র প্রেরণ করেছি। যদি এটা পাস হয়, তাহলে আমরা নতুন গাছীদের প্রশিক্ষণ সহ নিপা ভাইরাস মুক্ত রস-গুড় উৎপাদন করার জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র দিতে পারবো।’

বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, যদি জেলার ১৬ লাখ ২৫ হাজার খেজুর গাছকে রস উৎপাদনের আওতায় আনা যায়, তবে উৎপাদিত গুড়-পাটালি নিঃসন্দেহে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হবে। সেই সম্ভাবনার পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, এই ঐতিহ্যবাহী পেশাটিকে বর্তমান প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে নতুন গাছি তৈরি করা এবং তাদের হাতে প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা পৌঁছে দেওয়া।

 

 

 

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)