ধ্রুব ডেস্ক
❒ ভূমধ্যসাগরের নৌকা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া গোপালগঞ্জের আশিক মিনা। ছবি: সংগৃহীত
দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন ভূমধ্যসাগরের নৌকা দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া গোপালগঞ্জের আশিক মিনা। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এর তত্ত্বাবধানে দেশে ফিরে ভয়ঙ্কর সেই যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
আশিক বলেন, “ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার পথটি শুধু দুর্বিষহই নয়; এটি জীবন শেষ করে দেওয়ার মত ভয়াবহ। মৃত্যুকে কয়েকবার খুব কাছে থেকে দেখেছি।”
মানবপাচারকারীদের প্রতারণা, লিবিয়ার নির্যাতন, নৌকার অতিরিক্ত যাত্রী-সব মিলিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল এই পথ।
মুকসুদপুর উপজেলার ননীক্ষীর ইউনিয়নের পূর্ব লওখণ্ডা গ্রামের হায়দার মিনার ছেলে আশিক মিনার চোখে-মুখে এখনও ঘটনার ভয়াবহতার ছাপ স্পষ্ট। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, কীভাবে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পড়েছিলেন।
আশিক বলেন, পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে ১৯ অক্টোবর তিনিসহ গ্রামের আরও ছয়জন দালালের মাধ্যমে নৌকায় চড়ে অবৈধপথে ইতালি যাওয়ার জন্য রওনা হন। বাকিদের কেউ এখনও বাড়ি ফেরেননি।
“তাদের কেউ কেউ নিখোঁজ, কেউ কারাগারে বা লিবিয়াতে চিকিৎসাধীন। তারা না ফেরা পর্যন্ত দা্লালদের বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
লিবিয়ার উপকূলের ভূমধ্যসাগরে তাদের বহনকারী নৌকাটি ডুবে যেতে শুরু করলে চারদিকে হাহাকার আর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নৌকায় থাকা ৭৫ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর অনেককে আশিক নিজের চোখের সামনেই উত্তাল সমুদ্রের পানিতে ভেসে যেতে দেখছিলেন। সেই ভয়ার্ত মুহূর্তে প্রতিটি সেকেন্ডে তিনি মৃত্যুকে কাছে অনুভব করেছেন, তবু প্রাণে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
আশিক বলেন, “আমরা প্রথম বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে যাই। সেখান থেকে মিশর হয়ে লিবিয়া পৌঁছাই। লিবিয়াতে প্রায় এক মাস বাঙালিদের বাসায় থাকি। ১৪ নভেম্বর রাতে আমাদের লিবিয়ানদের বাসায় নেওয়া হয়। পর দিন ১৫ নভেম্বর রাতে সাগরপাড় থেকে ইঞ্জিন নৌকায় তোলা হয়। আমাদের নৌকা ইতালির উদ্দেশে রওনা দেয় রাতে সাড়ে ৮টার দিকে। রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার দিকে দুর্ঘটনা ঘটে।
“নৌকা ছাড়ার কিছুক্ষণ পর দেখি সামনে কোস্ট গার্ডের জাহাজ। সাধারণত কোস্ট গার্ডের সঙ্গে চুক্তি করা থাকে, তারাই নৌকাগুলোকে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের নৌকার চুক্তি ছিল না। অনেকক্ষণ চলার পরে দেখি কোস্ট গার্ডের সদস্যরা পেছন থেকে গুলি করছে। গুলি করার পরে আমাদের নৌকা এক জায়গায় ঘুরতে থাকে এবং এক পর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে কোস্ট গার্ডের বড় জাহাজ আমাদের নৌকার ওপর উঠে যায়। এরপর কী হয়েছে, কে কোথায় গেছে, কিছুই বুঝতে পারি নাই। দুর্ঘটনার পর কারো অবস্থাই তখন বোঝার উপায় ছিল না।”
“নৌকা একদম ভেঙে গেছিল। কোস্ট গার্ডের বড় জাহাজ পুরো বোটের ওপর ওঠেছিল। মনে হয় না ঘড়ির এক সেকেন্ডের কাটাও ঘুরছে, এর আগেই সব শেষ।”
তিনি বলেন, “গুলিতে কেউ মারা যায়নি। কিন্তু নৌকা থামার পর যে দুর্ঘটনা, তাতেই সব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মনে হয়, আল্লাহ নিজে নেমে আমাকে বাঁচাইছে। ওরা যেন খেলা দেখছিল, মানুষের জীবন কীভাবে যায় সেটাই দেখছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে শুধু দেখছে কারা বাঁচে, কারা মরে। আধা ঘণ্টা পর তারা উদ্ধার করছে। নৌকায় ছিলাম ৭৫ জন। মিশরের ছিল পাঁচজন; বাকি সব বাঙালি।”
দুর্ঘটনায় আশিকের হাত-পা ভেঙে গেলে ১৯ দিন হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। সেসময়ও তার প্রতিক্ষণ কেটেছে পরিবারের সদস্যদের কথা ভেবে।
আশিক বলেন, “এখন আল্লাহর রহমতে একটু সুস্থ। আমাকে দুইটা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। প্রথমে একটায়, তারপর আরেকটায় স্থানান্তর করে। অপারেশনের পর আবার অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মোবাইলও ছিল না, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নাই।
“ভাবছিলাম যদি আমার কোনো খোঁজ না পায়, মা বাঁচবে না। লিবিয়াতে আইওএম আমাদের চিকিৎসা দিয়েছে। তারা বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে আমাদের দেশে পাঠিয়েছে। ফ্লাইট ছিল ৪ ডিসেম্বর। আর ৫ ডিসেম্বর দেশে এসে পৌঁছাই।”
আশিক মিনার মা রওশন আরা বেগম ছেলেকে ফিরে পেলেও দেনা মেটানোর দুশ্চিন্তায় তার কপালে ভাঁজ পড়েছে।
৫৫ বছর বয়সী রওশন আরা বলেন, “আল্লাহর কাছে আমার লাখ লাখ শুক্রিয়া যে, আমার ছেলে মৃত্যুর ঘর থেকে ফিরে এসেছে। ধার-কর্য, জমি বিক্রি করে ও ঋণ তুলে দালালকে ২১ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। বডি কন্ট্রাক্ট ২১ লাখ টাকায় দালাল পার করে দেবে ইতালি। দুর্ঘটনার কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর ছেলে হাসপাতাল থেকে আমাদের মোবাইলে ফোন দেয়।
“এখনো বুকের ভেতর ভালো লাগে না, ছেলে তো আইছে। কিন্তু দেনার দুশ্চিন্তায় মনের ভেতর ঢেউ ওঠে।”
আশিক মিনার চাচাতো ভাই সোহাগ মিনা বলছিলেন, “আমার চাচাত ভাইসহ এলাকার আরও ছোট ভাই-ব্রাদাররা ২০ থেকে ২২ লাখ টাকা দালালদের হাতে তুলে দিয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় যায়। কিন্তু সেখানে তাদেরকে ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়।
“আমার ভাই কোনো রকমে ফিরে এসেছে সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায়। বিদেশ যাওয়ার জন্য সে ঘরবাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখেছিল। এতে সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে, অর্থনৈতিকভাবেও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমরা চাই আর কোনো মানুষের জীবন নিয়ে দালালরা যেন এভাবে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। তাই সবার প্রতি আমাদের অনুরোধ, এসব দালালের কঠোর বিচার হোক। ভবিষ্যতে আর কেউ যেন তাদের প্রতারণার শিকার না হয়।”
আশিক মিনা বলছিলেন, “আমি কখনো কল্পনাও করি নাই আবার মায়ের মুখ দেখতে পারব। জীবনে এমন পরিস্থিতিতে পড়ব এটা কোনোদিন ভাবিনি। দেশে আসার পরে এখন আমি শুধু সবাইকে বলি, এই পথে কেউ পা দিও না। এটা একেবারে মরণপথ। যারা যাবে তাদের সবাইকে আমি হুঁশিয়ার করে দেই, এই পথ জীবন শেষ করে দেয়।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনশক্তি ও কর্মসংস্থান অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্ঠীপদ রায় বলেন, “অবৈধ পথে ইতালি যেতে আমরা বরাবর নিরুৎসাহিত করে আসছি। ওই পথ নিরাপদ নয়; জীবনের ঝুঁকি আছে।”
জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এসব নিয়ে প্রচার চালানো হয়েছে এবং সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক ও সভা-সমাবেশ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, “বৈধ পথে সরকার ইতালি যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমরা সেটিও বলছি। কিন্তু বৈধ পথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা একেবারেই কম। পরিবার ও যুব সমাজ সচেতন হলেই মৃত্যুর এই মিছিল থামানো সম্ভব হবে।” সূত্র: বিডিনিউজ