ধ্রুব ডেস্ক
❒ রূপবান ছবির পত্রিকা বিজ্ঞাপন। ছবি: সংগৃহীত
দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে দর্শকরা কোমরে চিড়া-মুড়ি গুঁজে গরুর গাড়িতে চড়ে সূর্য ওঠার আগেই রওনা হতেন শহরের সিনেমা হলের উদ্দেশে। কেউবা প্রমত্তা পদ্মা পেরিয়ে আসতেন। পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলে হলসংলগ্ন মাঠেই রাত কাটিয়ে পরদিনের শো দেখতেন। অনেকে টানা দু-তিনটি শো দেখে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছেনও।
অনেক ঘটনা ঘটিয়েছিল রূপবান, যার বয়স আজ ৬০ বছর। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রের কাহিনি ছিল লোকগাথাভিত্তিক—যে গল্প বহুদিন ধরে যাত্রামঞ্চে পরিবেশিত হয়ে আসছিল। রহিম, রূপবান আর তাজেলকে রূপালি পর্দায় কেমন লাগে, তা দেখার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন।
দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে দর্শকরা কোমরে চিড়া-মুড়ি গুঁজে গরুর গাড়িতে চড়ে সূর্য ওঠার আগেই রওনা হতেন শহরের সিনেমা হলের উদ্দেশে। কেউবা প্রমত্তা পদ্মা পেরিয়ে আসতেন। পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলে হলসংলগ্ন মাঠেই রাত কাটিয়ে পরদিনের শো দেখতেন। অনেকে টানা দু-তিনটি শো দেখে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছেনও। গ্রামের মা-চাচিরা, যারা কোনোদিন সিনেমা হলে যাওয়ার কথা ভাবেননি, তারাও রূপবান দেখতে ঘর ছেড়েছিলেন।

ইবনে মিজান নির্মাণ করেছিলেন আবার বনবাসে রূপবান।
দোস্ত দুশমন-এর পরিচালক দেওয়ান নজরুল তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। সিরাজগঞ্জের লক্ষ্মী হলে তিনি প্রথম রূপবান দেখেছিলেন। তার ভাষায়, "রূপবান জনপ্রিয় হওয়ার কারণ হলো এটি মাতৃত্বনির্ভর ছবি, যেখানে ১২ দিনের এক শিশুকে তার ১২ বছর বয়সী স্ত্রী বড় করে তোলে।"
তিনি আরও বলেন, "এই ছবির সবচেয়ে বড় অবদান হলো—এটি দর্শককে উর্দু সিনেমা থেকে বাংলা সিনেমার দিকে ফিরিয়ে এনেছিল।"
ষাটের দশকে ধারাপাত, যে নদী মরু পথে, সুতরাং, কাঁচের দেয়াল—এর মতো সৃজনশীল ও সমাজসচেতন চলচ্চিত্র তৈরি হলেও সেগুলো বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। ফলে প্রযোজকেরা লাভের আশায় উর্দু সিনেমা নির্মাণে ঝুঁকে পড়েন। চান্দা, তালাশ, মালা, চকোরি, সংগম—এসব ছবির দাপটে বাংলা সিনেমা তখন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে।
এই অন্ধকারে আলো জ্বালেন পরিচালক ও প্রযোজক সালাহউদ্দিন। তিনি নির্মাণ করেন রূপবান—যা বদলে দেয় পুরো চিত্রপট।
চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ছটকু আহমেদ বলেন, "লোককাহিনীভিত্তিক ছবির মধ্যে বেদের মেয়ে জোছনার আগে রূপবানই ছিল সবচেয়ে ব্যবসাসফল। এর সাফল্যে লোককাহিনীভিত্তিক ছবি নির্মাণের হিড়িক পড়ে—বনবাসে রূপবান, আবার বনবাসে রূপবান, রহিম বাদশা ও রূপবান, সাত ভাই চম্পা, কমলার বনবাস, মহুয়া, কাঞ্চনমালা, বেহুলা, আলোমতি, গুনাইবিবি, অরুণ বরুণ কিরণমালা—ইত্যাদি। শুধু রূপবান-ই রিমেক হয়েছে আধা ডজনেরও বেশি।"
ছবিটির বাজেট ছিল মাত্র দেড় লাখ রুপি, অথচ আয় করেছিল প্রায় ২০ লাখ। রূপবান মুক্তি পেয়েছিল ১৭টি হলে—যা সে সময়ের জন্য রেকর্ড। পঁয়ষট্টির পরের কয়েক বছর একচ্ছত্র রাজত্ব করেছে এই চলচ্চিত্র।
সে সময়কে অনেকে বলেন 'রূপবান যুগ'। কারণ, তখন বাজারে পাওয়া যেত রূপবান নামের সিগারেট, আলতা, কেরোসিন তেল এমনকি ঘুমের বটিকাও!
চলচ্চিত্র–সংশ্লিষ্টদের মতে, রূপবান–ই ছিল বাংলা সিনেমা ইতিহাসের প্রথম সত্যিকারের সুপারহিট ছবি।
সত্য সাহার সংগীত আয়োজনে আব্দুল আলীম ও নীনা হামিদের মায়াভরা কণ্ঠে রূপবান–এর গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে বহুকাল। 'ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো', 'বিদায় দেন বিদায় দেন', 'মেরো না জল্লাদ'—এই গানগুলো আজও শ্রোতার হৃদয়ে অনুরণিত হয়।

রূপবানের নাম ভূমিকায় ছিলেন সুজাতা।
চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক ছটকু আহমেদ নিজেও রূপবান–এর রিমেক করেছিলেন। ইমপ্রেস টেলিফিল্ম প্রযোজিত ছবিটির নাম ছিল আজকের রূপবান। ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি তিনি আকন্দ সানোয়ার মোরশেদের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন।
ছটকু আহমেদ বলেন, "মূলত বিদেশি দর্শকদের জন্যই ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। তারা বলতেন, তোমাদের যাত্রাপালা আমরা দেখিনি, একবার দেখার সুযোগ করে দাও। তাই মঞ্চ বেঁধে যাত্রার ঢঙেই ছবিটি শুট করা হয়।"
"কিছু আউটডোর শুটিং হয়েছিল পুবাইলে। ইনডোর ও আউটডোরের অনুপাত প্রায় ৭০ ও ৩০ ভাগ। নায়িকা কেয়া অভিনয় করেছিলেন রূপবানের চরিত্রে। ছবিটি ফ্রান্সের প্যারিসে প্রদর্শিত হয়ে প্রশংসা পেয়েছিল। আসলে গানই ছিল ছবিটির প্রাণ—গান দিয়েই এটি দর্শকের হৃদয় জয় করেছিল," যোগ করেন তিনি।
কুষ্টিয়ার মেয়ে তন্দ্রা মজুমদার এই সিনেমায় সুজাতা নামে আত্মপ্রকাশ করেন এবং রূপবানের নাম ভূমিকায় অভিনয় করে পৌঁছে যান খ্যাতির শীর্ষে। লোকমুখে তার পরিচয় হয়ে যায় 'রূপবান কন্যা'। শোনা যায়, ছবির একটি দৃশ্যে যেখানে সুজাতা বাঁশে হাত রেখে গান গেয়েছিলেন, সেই বাঁশটি নিলামে বিক্রি হয়েছিল ৬০ টাকায়—যে সময় এক আনারও দাম ছিল অনেক। তখন সুজাতা কোথাও গেলে দর্শকের ঢল নামত, কখনো কখনো ভিড় সামলাতে পুলিশকেও নামতে হতো।
বাংলা সিনেমার কিংবদন্তি পোস্টারশিল্পী বিদেশ কুমার ধর তখন ১৯৬৫ সালে হাফপ্যান্ট পরা এক কিশোর। পারিবারিকভাবেই তিনি ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার তালিম পেয়েছিলেন। জুপিটার পাবলিসিটি থেকে গুলিস্তান সিনেমা হলের জন্য রূপবান–এর একটি ব্যানার আঁকার কাজ পান। সাদা–কালো রঙে আঁকা ১০ বাই ৪ ফুটের তার সেই সাইড ব্যানারটি বেশ প্রশংসা কুড়ায়।
বিদেশ কুমার ধর বলেন, "রূপবান–এর সব শো ছিল হাউজফুল। টিকিট না পেয়ে অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করত। ছবিটিতে রস ছিল, ইমোশন ছিল, তাই দর্শককে টানতে পেরেছি।"
শেষে অল্পকথায় ছবিটির গল্প—দেশের রাজা একাব্বর বাদশার মনে সুখ নেই, কারণ তার সন্তান হয় না। দুঃখে তিনি বনে যান এবং এক মুনির সঙ্গে দেখা হয়। মুনি তাকে বর দেন, বলেন, শিগগিরই এক পুত্রসন্তান হবে, তবে শর্ত—সন্তানের বয়স বারো দিন হলে তাকে বিয়ে দিতে হবে বারো বছরের এক কন্যার সঙ্গে এবং সেদিনই পাঠাতে হবে নির্বাসনে। বাদশা রানীকে সব খুলে বলেন, রানী দুঃখ পেলেও রাজি হন।
পুত্র জন্মের পর পাত্রী খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। শেষে উজিরের বারো বছর বয়সী কন্যা রূপবানের সঙ্গে নবজাতক রহিমের বিয়ে দেন একাব্বর বাদশা। তারপর রূপবান বারো দিনের স্বামীকে নিয়ে বনে চলে যায়।
জঙ্গলের রাজা নানা বিপদে তাদের সহায়তা করেন। ধীরে ধীরে রহিম বড় হয়, কিন্তু রূপবান নিজের পরিচয় গোপন রাখে। রূপে–গুণে রহিম হয়ে ওঠে দশের মধ্যে এক। একসময় তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়, সেখানে ছায়েদ বাদশার কন্যা তাজেল রহিমের প্রেমে পড়ে।
ছায়েদ বাদশা রহিমকে কারাগারে নিক্ষেপ করলে জঙ্গলের রাজা এসে তাকে উদ্ধার করেন। এর মধ্যেই বনবাসের বারো বছর পূর্ণ হয়। ফলে মুনির দেওয়া শর্ত পূর্ণ হয়। রহিম ও রূপবান ফিরে আসে একাব্বর বাদশার প্রাসাদে—সুখে শান্তিতে শুরু হয় তাদের নতুন জীবন।