সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)

শিল্পী সৃষ্টিতে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা প্রকট

❒ যশোরে অর্ধশতাধিক সংগঠন থাকলেও তৈরি হচ্ছে না নতুন প্রতিভা

বিশেষ প্রতিনিধি বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : রবিবার, ২৩ নভেম্বর,২০২৫, ০১:৩১ পিএম
শিল্পী সৃষ্টিতে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা প্রকট

❒ নতুন কুঁড়ি বিজয়ী সাবিক সাদত, আয়শা সিদ্দকা, আইয়ান রেজা ও অর্য্যশ্রী বিশ্বাস ছবি: বিটিভির ওয়েবসাইট

বছর কুড়ি পর আবার শুরু বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘নতুন কুঁড়ি’। এতে কৌতুকে যশোরের সাবিক সাদত চমকে দিয়েছে। সম্ভাবনার দরোজা খুলে দেখিয়ে দিয়েছে এ জেলার দ্যুতি কীভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায় দেশময়। চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সাবিক।

একই পথে আরও তিন শিশু কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। গৌরময় যশোরকে উপরে তুলে ধরেছে।

তবু দুর্ভাগা এসব শিশু। একদা কবি মধুসূদন দত্ত যশোরের ঐতিহ্য তুলে ধরেছিলেন তার কবিতায়। কাজ করে দেখিয়েছিলেন কর্মবীর মুনশি মেহেরুল্লাহ। বলেছিলেন ’ভাব মন দমে দম, রাহা দূর বেলা কম’। প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাসে ভাব মন, রাস্তা আমাদের অনেক দূর। সেই তুলনায় সময় অনেক কম।

হয়তো শিশুরা কাজ করেছে বটে, তবে তাদের জন্য জেলার কর্তাব্যক্তিদের তরফে জোটেনি তেমন কিছু। খবরে যেসব নজির মিলছে তাতে অন্য জেলা এর ব্যতিক্রম।

কাজ করে না দেখালে, শিশুদের উৎসাহ না দিলে কীভাবে যশোর তার যশ ধরে রাখবে? এটা যেমন ভাবনার, তেমনি দুর্ভাবনার যশোরের সাংস্কৃতিক দীনতা নিয়ে।

সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের একসময়ের লীলাভূমি যশোর ক্রমাগত জৌলুস হারাচ্ছে কি? এই জিজ্ঞাসা বড় হয়ে উঠেছে। জেলায় পঞ্চাশের বেশি সাংস্কৃতিক সংগঠন রয়েছে। তবু কার্যক্রমে কেন এই স্থবিরতা?  বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের শিল্পী বা 'সাংস্কৃতিক যোদ্ধা' তৈরির ক্ষেত্রে সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা প্রকট বলে প্রতীয়মান। জাতীয় পর্যায়েও যশোরের ভূমিকা আগের মতো উজ্জ্বল নয়।

দুর্বলতার চিত্র সম্প্রতি জাতীয়ভাবে শেষ হওয়া বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো 'নতুন কুঁড়ি' প্রতিযোগিতায় স্পষ্ট হয়েছে । দীর্ঘ ২০ বছর পর শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতায় সেরা পাঁচে যশোরের অবস্থান হতাশাজনক। প্রতিযোগিতায় একজন প্রথম, দুইজন দ্বিতীয় এবং একজন তৃতীয় স্থান অর্জনকারীকে নিয়ে জেলাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।

সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এই চারজন কৃতী শিশুকে নিয়ে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রচারণা, সংবর্ধনা, অভিনন্দন বা আলোচনাও চোখে পড়েনি। নতুন প্রতিভাদের উৎসাহ দিতেও তারা হীনমন্যতার পরিচয় দিয়েছে। 

বিস্ময়করভাবে, যে শিশুটি প্রথম হয়েছে—সে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিক্ষার্থী নয়। তবে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী এক প্রতিযোগীকে নিয়ে একাধিক সংগঠন নিজেদের সদস্য বলে দাবি করলেও, অপর বিজয়ীদের ক্ষেত্রে সংগঠনের তেমন কোনো প্রভাব বা ভূমিকা শোনা যায়নি। এমনকি জেলা শিল্পকলা একাডেমির কাছেও তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিস্তারিত তথ্য ছিল না; পরে প্রতিষ্ঠানটি বিটিভির ওয়েবসাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।

খুলনা-২ অঞ্চল (যশোর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা) থেকে অডিশন রাউন্ডে প্রায় আড়াই হাজার শিশুর অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে ইয়েস কার্ড পেয়েছিল ৫ শতাধিক। কিন্তু ৫ ধাপ পেরিয়ে এই ৪ জন প্রতিভাবান শিশু চূড়ান্ত পুরস্কার নিয়ে ঘরে ফিরেছে। এদের মধ্যে সাবিক সাদাত, 'ক' বিভাগের কৌতুকে প্রথম হয়েছে।  সে কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিক্ষার্থী নয়।

আয়েশা সিদ্দিকা: 'ক' বিভাগের গল্পবলা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছে। সে থিয়েটার ক্যানভাসের সদস্য। আইয়ান রেজা: 'ক' বিভাগে লোকসঙ্গীতে দ্বিতীয় হয়েছে। সে উদীচী ও শিল্পকলা একাডেমির শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। এবং অর্য্যশ্রী বিশ্বাস অর্পিতা: 'ক' বিভাগের নৃত্যে তৃতীয় স্থান পেয়েছে। সে নৃত্যবিতানের শিক্ষার্থী।

সার্বিকভাবে অনেকেই মনে করছেন, অতীতে যশোরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর একটি বড় অংশ প্রতিভা বিকাশে মনোযোগী হওয়ার চেয়ে রাজনৈতিক তোষণে বেশি ব্যস্ত ছিল। তবে এই সমালোচনা নিয়ে ভিন্ন অবস্থান সংগঠনের নেতৃবৃন্দের।

থিয়েটার ক্যানভাসের প্রধান সম্পাদক কামরুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘সাংস্কৃতিক তীর্থভূমি হলেও আমরা সময়ের সাথে তাল মেলাতে পারিনি। এক ধরনের তৃপ্তির ঢেকুর নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। গড়ার চেয়ে প্রচারে বেশি বিশ্বাসী হয়েছি বাণিজ্যিকীকরণের ধারায়। অনেক সংগঠন মূল ধারার কাজ রেখে প্রচার ও ব্যানারসর্বস্বতা নিয়ে ব্যস্ত।’

তিনি আরও বলেন, ‘যশোরে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পুরোপুরি রাজনীতির প্রভাবে চলে না, তবে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সচেতনতা রয়েছে।’

কয়েকজন অভিভাবক জানান, আগে প্রায় সারা বছর বিভিন্ন সংগঠনের আয়োজনে অনুষ্ঠান লেগে থাকত। বর্তমানে সেই আয়োজন অনেক কমে গেছে।

কারো কারো দাবি, অতিরিক্ত কোচিংয়ের প্রভাবে অভিভাবকরা শিশুদের সাংস্কৃতিক বিকাশ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন। বইয়ের বোঝা আর কোচিংয়ের ঘন ঘন পরীক্ষা-প্রতিযোগিতার কারণে শিশু ও অভিভাবকরা আতঙ্কিত—এই বুঝি তাদের সন্তানরা পড়ালেখায় পিছিয়ে পড়ে!

উদীচী যশোরের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান বিপ্লব সাংগঠনিক দুর্বলতা বা রাজনৈতিক প্রভাব মানতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘নতুন কুঁড়ির অডিশন স্কুল পর্যায়ের ছিল, সংগঠন ভিত্তিক নয়। বিচারকদের বিচারকে আমরা সম্মান জানাই... তবে আগের মতো শেখার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থী কম পাওয়া যাচ্ছে, পড়াশোনা নিয়েও অভিভাবকরা ব্যস্ত।’

 

জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার জসীম উদ্দীন জানান, অনেক দিন ধরে 'নতুন কুঁড়ি'র মতো জাতীয়মানের আয়োজন না হওয়ায় অনেকে হয়তো প্রতিযোগিতার মানসিকতায় শেখে না। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, আগামীতে সংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের এ জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত করবে। তিনি আরও জানান, বিটিভি সব তথ্য নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, জেলা পর্যায়ে কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করেনি।

বিটিভি’র গ্রাফিক্স বিভাগের প্রধান মো. আনোয়ার সাদাত রবি, যিনি খুলনা-২ অঞ্চলের অডিশন রাউন্ডের আহ্বায়ক ছিলেন, জানান, ‘ঢাকার পরেই আমরা যশোরের অবস্থান ধরি। সে হিসেবে এখানে বিপুল সংখ্যক ইয়েস কার্ড বিজয়ী ও চূড়ান্ত পর্বে নিজেদের স্বাক্ষর রাখা প্রতিভাবানদের খুঁজে পাবো আশা করেছিলাম, কিন্তু বাস্তবতা তেমনটি হয়নি।’

 

ধ্রুব নিউজের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

💬 Comments

Login | Register
Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)