ধ্রুব ডেস্ক
ছবি: সংগৃহীত
মানুষ চাকা আবিষ্কার করেছিল জীবন সহজ করতে। কিন্তু আজ সেই উদ্ভাবনের ধারাবাহিকতায় মানুষের চিন্তাশক্তিকেই চ্যালেঞ্জ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (AI)। তবে এই এআই-এর লড়াই এখন আর শুধু সফটওয়্যার বা অ্যালগরিদমে সীমাবদ্ধ নেই; বরং এটি রূপ নিয়েছে এক নতুন 'শীতল যুদ্ধে'। আর এই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সেমিকন্ডাক্টর বা উন্নত চিপ তৈরির প্রযুক্তি।
পশ্চিমা বিশ্বের চিপ-অবরোধ গুঁড়িয়ে দিতে চীন এখন এক বিশাল ও গোপন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু করেছে। রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য—যাকে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা তৈরির ঐতিহাসিক 'ম্যানহাটন প্রকল্পের' চীনা সংস্করণ।
কেন এই লিথোগ্রাফি যুদ্ধ?
আধুনিক এআই মডেল, সুপার কম্পিউটার কিংবা উন্নত যুদ্ধাস্ত্র তৈরির মূল চাবিকাঠি হলো ইইউভি (EUV) লিথোগ্রাফি প্রযুক্তি। এই যন্ত্রের মাধ্যমে সিলিকনের ওপর মানুষের চুলের চেয়েও হাজার গুণ পাতলা সার্কিট খোদাই করা হয়। ১৮০ টন ওজনের এই দানবীয় যন্ত্রের দাম প্রায় ২৫ কোটি ডলার, যা বর্তমানে বিশ্বে কেবল নেদারল্যান্ডসের কোম্পানি এএসএমএল (ASML) তৈরি করে।
২০১৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এএসএমএল চীনের কাছে এই যন্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দিলে বেইজিং প্রযুক্তিগতভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু হার মানতে নারাজ শি জিনপিং প্রশাসন।
হুয়াওয়ের নেতৃত্বে গোপন অভিযান
চীনের এই পাল্টা অভিযানের নেতৃত্বে রয়েছে দেশটির প্রযুক্তি জায়ান্ট হুয়াওয়ে। শেনঝেনের এক উচ্চ-নিরাপত্তা সম্পন্ন ল্যাবে চীনা বিজ্ঞানীরা গোপনে তৈরি করছেন নিজস্ব লিথোগ্রাফি যন্ত্র।
রয়টার্স জানিয়েছে, চীনারা ইতোমধ্যে লিথোগ্রাফির জন্য প্রয়োজনীয় আলোর উৎস তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন এই প্রযুক্তি অর্জনে চীনের কয়েক দশক লাগবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সূত্রের দাবি, ২০২৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যেই নিজস্ব এআই চিপ উৎপাদনে যাবে চীন।
চীনের ‘গ্রে জোন’ কৌশল: অর্থ ও বুদ্ধির লড়াই
নিজেদের লক্ষ্যপূরণে চীন এক অভিনব 'গ্রে জোন' কৌশল নিয়েছে:
প্রথমত, প্রকৌশলী নিয়োগ: এএসএমএলের সাবেক প্রকৌশলীদের বিশাল অঙ্কের বেতনে (বার্ষিক ৪ থেকে ৭ লাখ মার্কিন ডলার) নিয়োগ দিচ্ছে চীন। নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, পুরোনো যন্ত্রের ব্যবচ্ছেদ: নতুন যন্ত্র কিনতে না পেরে চীন নিলাম থেকে পুরোনো যন্ত্র কিনে সেগুলো খুলে প্রতিটি পার্টস নিয়ে গবেষণা করছে। তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি দল এসব যন্ত্রাংশ জোড়া লাগিয়ে ভিডিও করে রাখছে ভবিষ্যতের জন্য।
বড় চ্যালেঞ্জ যেখানে
চীনের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা জার্মানির তৈরি বিশেষ 'অপটিক্যাল সিস্টেম'। প্রতি সেকেন্ডে ৫০ হাজার বার লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করে যে প্লাজমা তৈরি হয়, তা প্রতিফলিত করার জন্য অত্যন্ত নিখুঁত আয়না প্রয়োজন, যা শুধু জার্মানির কার্ল জাইস তৈরি করতে পারে। এই বাধা টপকানোই এখন বেইজিংয়ের প্রধান লক্ষ্য।
বদলে যাবে আগামীর বিশ্ব
বিশ্লেষকদের মতে, চীন যদি এই ইইউভি প্রযুক্তিতে সফল হয়, তবে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির মোড় ঘুরে যাবে। সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছিটকে দিয়ে চীন হয়ে উঠবে এআই ও সামরিক হার্ডওয়্যারের একচ্ছত্র অধিপতি। পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের চিপ-আধিপত্য এবার বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটের মুখে।